কারাগারের প্রাচীর পেরিয়ে সুরের আশার আলো, ঈদের আয়োজনে গান গেয়ে আলোচনায় বন্দি নোবেল।
বিশেষ প্রতিবেদন | ফিনিক্স নিউজ | ৮ জুন ২০২৫ | ঢাকা
“কারাগার”—একটি শব্দ, যার মধ্যে বন্দিত্ব, অনুশোচনা, সংশোধন আর বিচ্ছিন্নতার বহুমাত্রিক বাস্তবতা লুকিয়ে থাকে। তবে সেই বাস্তবতার ভেতরেও আশার আলো জ্বালাতে পারে সঙ্গীত, ভালবাসা আর মানবিক কোনো মুহূর্ত। ঈদুল আজহার দিনে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত এক ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক আয়োজন যেন সেই প্রমাণই রাখল। আর সেই আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন একজন বিতর্কিত কিন্তু প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী—মইনুল আহসান নোবেল।
কারাগারে ঈদ, উৎসবে গান – ভিন্ন আবহ:
গতকাল শনিবার (৭ জুন) বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের খোলা মাঠে বন্দিদের জন্য আয়োজন করা হয় ঈদের বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আয়োজনটির উদ্যোগ নেয় কারা কর্তৃপক্ষ, যা ছিল ঈদের দিন বন্দিদের মানসিক প্রশান্তি ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে। এ আয়োজনের মাধ্যমে একদিকে যেমন বন্দিদের মাঝে একঘেয়েমি কাটিয়ে কিছুটা আনন্দের উপলক্ষ তৈরি হয়, অন্যদিকে সমাজের প্রতি ইতিবাচক বার্তাও পৌঁছায়—সংশোধনের সুযোগ ও সম্ভাবনার।
এই অনুষ্ঠানেই হাজির হন সংগীতশিল্পী মইনুল আহসান নোবেল, যিনি বর্তমানে নারী নির্যাতন মামলায় কারাবন্দি। মঞ্চে উঠে নোবেল গেয়ে ওঠেন নিজের জনপ্রিয় গান—‘অভিনয়’, ‘ভিগি ভিগি’, ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হয়ে গেলে’সহ আরও কয়েকটি হৃদয়ছোঁয়া গান। তাঁর কণ্ঠে গান শুনে অন্য বন্দিরাও এক মুহূর্তের জন্য যেন হারিয়ে যান মুক্ত জীবনের স্মৃতিতে। বন্দিদের মাঝে সৃষ্টি হয় এক ব্যতিক্রমী আবেগঘন পরিবেশ—যেখানে অশ্রু, উল্লাস আর স্মৃতিকাতরতা মিশে একাকার হয়ে যায়।
নোবেল ও নগর বাউলের গান—দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধন:
এই আয়োজনে নোবেল কভার করেন নগর বাউল জেমসের একটি গানও, যা বিশেষভাবে আলোচিত হয়। জেমসের গানে যেখানে ছিল ‘জেল থেকে বলছি’-এর প্রতীকী ব্যঞ্জনা, সেখানে নোবেলের গানে ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। হয়তো এই তুলনা অনেকের কাছে বিতর্কিত, কিন্তু তাতে গানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের প্রমাণ স্পষ্ট।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক কারা কর্মকর্তা ফিনিক্স নিউজকে বলেন,
“আমরা চাই, কারাগার শুধু শাস্তির জায়গা না হোক; এটি হোক সংশোধনের ক্ষেত্র। সংগীত, সাহিত্য, সংস্কৃতি—এই মাধ্যমগুলো আমাদের সেই পথে এগোতে সাহায্য করে। নোবেল যেভাবে সাড়া দিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।”
একটি ভাইরাল ভিডিও, একটি মামলা, একটি নতুন অধ্যায়:
সম্প্রতি নোবেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিরোনামে আসেন একটি নারী নির্যাতনের অভিযোগে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি একজন নারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করছেন। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর ভুক্তভোগীর পরিবার ৯৯৯-এ ফোন করে অভিযোগ জানায়। পরে ডেমরা থানা পুলিশ ১৯ মে রাতে ওই নারীকে উদ্ধার করে এবং রাতেই গ্রেফতার করা হয় নোবেলকে। মামলাটি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।
সংশোধনের আশা, ভবিষ্যতের দিশা:
নোবেল একসময় রিয়েলিটি শো-এর মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। তাঁর কণ্ঠ ও সুর ছুঁয়ে যায় লাখো শ্রোতার হৃদয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিতর্ক, আচরণগত সমস্যা ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানামুখী সমালোচনার জন্ম দেন তিনি। এবার নিজেই এক কঠিন সময়ে, নিজের কর্মফল নিয়ে বসে আছেন জেলের অন্তরালে। তবে ঈদের দিনে কারাগারের মধ্যে গান গাওয়ার ঘটনাটি তাঁর জীবনের নতুন এক বাঁক—যেখানে হয়তো নিজেকে শুদ্ধ করে, সংশোধিত হয়ে আবারও গানের জগতে ফিরে আসার পথ তৈরি হচ্ছে।
‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’-এর বাস্তব প্রতিফলন?
১৯৯৪ সালের বিখ্যাত সিনেমা The Shawshank Redemption-এ যেমন অ্যান্ডি বন্দিদের জন্য এক মুহূর্তের মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিলেন, তেমনি নোবেলও হয়তো সেদিন বন্দিদের মাঝে একটুকরো ‘আশা’ জাগিয়ে তুলেছিলেন। সিনেমার ভাষায় বলতে গেলে, “Hope is a good thing… maybe the best of things.”
নোবেলের জন্য হয়তো এই কারাগার শুধুই শাস্তির জায়গা নয়—বরং নিজের ভুল বুঝে ওঠার, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার, এবং নতুনভাবে পথচলা শুরু করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।
শেষ কথা:
কারাগারের দেয়ালের আড়ালে ঈদের দিনে সংগীতের এমন উৎসব সামাজিক পুনর্বাসনের এক চমৎকার দৃষ্টান্ত। বিতর্কিত হলেও, নোবেল এই আয়োজনের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন, শিল্পীর দায়িত্ব শুধু শিল্প সৃষ্টি নয়—মানুষের হৃদয়ে আশার বীজ বপন করাও।
ভবিষ্যতে তিনি কেমন মানুষ হয়ে ফিরে আসবেন, সেটি সময়ই বলবে। তবে এদিন তাঁর গানের মাঝে বন্দিরা খুঁজে পেয়েছিলেন এক চিলতে মুক্তির আনন্দ।
ফিনিক্স নিউজ | নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা
📆 প্রকাশিত: ৮ জুন ২০২৫
🖋️ লেখা ও সম্পাদনা: রিপোর্টিং ডেস্ক
🔔 আরও মানবিক গল্প, সংস্কৃতি ও সমাজ সচেতনতামূলক সংবাদ পড়তে চোখ রাখুন [Finix News]-এ।