Friday, September 12, 2025
Homeবাংলাদেশজাতীয়জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫: দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক সংস্কারের যুগান্তকারী রূপরেখা।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫: দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক সংস্কারের যুগান্তকারী রূপরেখা।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫: দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক সংস্কারের যুগান্তকারী রূপরেখা।

ফিনিক্স নিউজ | বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। এই সনদে দুর্নীতি দমন, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিতকরণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫
ছবি: সংগৃহিত | জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫

গত বছর ৮ই আগস্ট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশব্যাপী সংস্কারের একটি বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ৭ অক্টোবর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়—সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন। পরবর্তীতে ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশসমূহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছে চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করা।


রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য গঠন:

ঐকমত্য কমিশন প্রথম পর্যায়ে গত ২০শে মার্চ থেকে ১৯শে মে পর্যন্ত মোট ৪৭টি বৈঠক করে, যেখানে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোট অংশগ্রহণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনার জন্য কমিশন ১৬৬টি সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠায়, যার মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে ৭০টি, নির্বাচন সংস্কারে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংস্কারে ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন বিষয়ে ২০টির বেশি সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এই আলোচনায় অংশ নেওয়া ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের লিখিত মতামতও কমিশনের কাছে জমা দেয়। পরবর্তীতে অগ্রাধিকারভিত্তিক ২০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ফলশ্রুতিতে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’।


সনদের মূল দিকনির্দেশনা:

১. আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশ

সনদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—সকল প্রার্থী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নির্বাচন কমিশনে আয় ও সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে, এবং কমিশন তা প্রকাশ্যে ওয়েবসাইটে তুলে ধরবে। এর ফলে জনগণ প্রার্থীর আর্থিক স্বচ্ছতা যাচাই করতে পারবে, যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।

২. দুর্নীতিবাজদের মনোনয়ন না দেওয়া

রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে। দলগুলো আর দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে দলীয় পদ কিংবা নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে পারবে না। এ বিধান কার্যকর হলে দীর্ঘদিন ধরে চলা দুর্নীতিবাজদের দলে পুনর্বাসনের সংস্কৃতি বন্ধ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

৩. সরকারি সেবায় অটোমেশন

থানা, রেজিস্ট্রি অফিস, রাজস্ব অফিস, পাসপোর্ট অফিস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সকল সেবাকে সম্পূর্ণ অটোমেশনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে ‘ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া যাবে না’—এমন ধারণা ভাঙবে বলে জনমনে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।

৪. বেসরকারি খাতের ঘুষকেও অপরাধ গণ্য

আগে শুধু সরকারি খাতে ঘুষ নেওয়াকে অপরাধ হিসেবে দেখা হলেও, নতুন সনদে বেসরকারি খাতে ঘুষ লেনদেনকেও স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে দণ্ডনীয় করা হয়েছে। ফলে ব্যবসায়িক লেনদেনেও স্বচ্ছতা বাড়বে।


সংস্কার কমিশনগুলোর ভূমিকা:

ঐকমত্য কমিশনে অন্তর্ভুক্ত ছয়টি পৃথক কমিশন তাদের নিজ নিজ খাতে সংস্কারের সুপারিশ দেয়।

  • সংবিধান সংস্কার কমিশন গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে।
  • নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য স্বচ্ছ তদারকি ও প্রযুক্তি নির্ভর পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে।
  • বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সহজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।
  • জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দক্ষতা ও সেবা নিশ্চিতকরণের দিক তুলে ধরেছে।
  • পুলিশ সংস্কার কমিশন জবাবদিহি ও মানবাধিকার সম্মত পুলিশিংয়ের ওপর জোর দিয়েছে।
  • দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও প্রতিরোধমূলক নীতি সুপারিশ করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া:

সনদের আলোচনায় অংশ নেওয়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দুর্নীতি দমন ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির বিষয়ে একমত হয়েছে। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার এই সনদের মাধ্যমে কার্যকর বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়েছে।

তবে কিছু দল আংশিক দ্বিমত প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, স্বচ্ছতার নাম করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সুযোগ রাখা যাবে না। এজন্য তারা একটি শক্তিশালী স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে।


চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা:

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। তাই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব, প্রশাসনের জটিলতা এবং প্রযুক্তিগত কাঠামো উন্নয়নের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।

তবে আশার দিকও রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষের অংশগ্রহণ এবং সর্বসম্মতভাবে সনদ গ্রহণ প্রমাণ করে যে, জাতি এখন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত


আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ:

বিশ্বব্যাপী স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বাংলাদেশ বরাবরই আলোচনায় থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীরা ইতোমধ্যেই জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-কে স্বাগত জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সনদ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে দুর্নীতির সূচক উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে এবং বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে।

‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ শুধু একটি নীতি দলিল নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা। এটি বাস্তবায়িত হলে জনগণ ঘুষ ও হয়রানি থেকে মুক্তি পাবে, রাজনৈতিক দলগুলো শুদ্ধ হবে, এবং প্রশাসনিক সেবা হবে অধিক কার্যকর ও প্রযুক্তিনির্ভর।

তবে সনদের সফলতা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক সক্ষমতা ও জনগণের অংশগ্রহণের ওপর। যদি তা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এই সনদ হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাইলফলক।


📣 আরও পড়ুন:


📢 Finix News – সত্য বলার সাহস
🌐 www.finixnews.com

🔗 আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া লিংক:


✅ সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন ও মন্তব্য করুন। আপনার মতামতই আমাদের শক্তি।
📲 Finix News | সত্যের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

আরও পড়ুন | Read More
আরও পড়ুন | Read More...

সর্বাধিক পঠিত | Popular Post