গাজা ধ্বংসে ইসরায়েলের নিয়োগ বিজ্ঞাপন: মানবাধিকার ও রাজনৈতিক প্রশ্নের মুখে এই ধ্বংসযজ্ঞ?
Finix News Desk | International
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫ইং
গাজার পরিস্থিতি: ধ্বংস, আশ্রয়হীনতা ও অনিশ্চয়তা:
২০২৩ সালের শেষ ভাগ থেকে শুরু হওয়া গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযানের ফলে সেখানে মানবিক বিপর্যয় চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, স্কুল, হাসপাতাল, বাজারসহ মৌলিক অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে নতুন এক মাত্রা যোগ হয়েছে যখন দেখা যায়, ইসরায়েলি ঠিকাদার ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক মাধ্যমে বিশেষভাবে ভবন ধ্বংসের জন্য জনবল নিয়োগ করছে।
বিশেষত, ফেসবুক গ্রুপ এবং পেজে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞাপনগুলোতে গাজা সীমান্তের নির্দিষ্ট এলাকায় কাজ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে, কাজটি হচ্ছে ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া।
ফেসবুক বিজ্ঞাপন: খোলা ভাষায় ধ্বংসযজ্ঞের নিয়োগ:
বিবিসি ভেরিফাই চিহ্নিত করে, ইসরায়েলি ঠিকাদাররা ফেসবুকে নিয়মিতভাবে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ‘এক্সক্যাভেটর অপারেটর’ নিয়োগের জন্য। একটি বিজ্ঞাপনে লেখা:
“নিয়োগ: গাজা সীমান্ত এলাকার জন্য অভিজ্ঞ এক্সক্যাভেটর অপারেটর। রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার, সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪:৪৫ পর্যন্ত কাজ। পরিবেশ ভালো। নিজস্ব যানবাহন থাকা আবশ্যক”
অন্য একটি পোস্টে দেখা যায়:
“গাজা উপত্যকায় একটি ভবন ধ্বংসের প্রকল্পের জন্য ৪০ টন এক্সক্যাভেটর অপারেটরদের জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ চলছে।
● দৈনিক ১২০০ শেকেল (ট্যাক্স ব্যতীত)
● আবাসন এবং খাবার প্রদান করা হবে
● ব্যক্তিগত গাড়ির সুযোগ
● অবিলম্বে শুরু
● পূর্ব অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় অনুমোদন থাকা বাধ্যতামূলক।”
ছবিগুলোতে ব্যক্তিগত তথ্য ঝাপসা করা হয়েছে, তবে কাজের প্রকৃতি একেবারে পরিষ্কার, ভবন ধ্বংস।
কোন এলাকায় চলছে এই ধ্বংস অভিযান?
বিজ্ঞাপনগুলোতে গাজার যেসব এলাকায় কাজ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো হলো:
- ফিলাডেলফি করিডর: গাজার দক্ষিণ সীমান্তে মিশরের সাথে একটি স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকা।
- মোরাগ অ্যাক্সিস: গাজায় পূর্বতন ইসরায়েলি বসতির একটি অঞ্চল, বর্তমানে আইডিএফ-এর কড়া নিয়ন্ত্রণাধীন।
এই এলাকা দুটোতে আগে থেকেই আইডিএফ সক্রিয় এবং সেখানে “নিরাপত্তা অঞ্চল” তৈরির কথা বারবার উঠে এসেছে।
ঠিকাদারের অশালীন উত্তর: মানবিক সংবেদনশীলতার ঘাটতি:
বিবিসি যখন একজন ঠিকাদারের কাছে এই ধ্বংস কার্যক্রম সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চায়, তিনি অশোভন ভাষায় বলেন:
“তুমি আর গাজা – দু’জনেই [অশালীন শব্দ]!”
এই ধরণের উত্তর শুধু মানবিকভাবে অগ্রহণযোগ্য নয়, বরং এই প্রচারণা ও নিয়োগের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
ধ্বংসের আসল উদ্দেশ্য কী?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধ্বংস শুধু কোনো ‘সামরিক প্রয়োজনে’ নয়, এর পেছনে রয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক এবং ভূ-নৈতিক উদ্দেশ্য। রাটগার্স ল’ স্কুলের অধ্যাপক আদিল হক বলেন:
“আইডিএফ সম্ভবত একটি নিরাপত্তা অঞ্চল তৈরি করছে, যা তারা দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।”
জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রেসিডেন্ট এফ্রাইম ইনবার বলেন:
“এই ধ্বংসের মাধ্যমে গাজাবাসীদের মধ্যে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
অর্থাৎ, পরিকল্পিতভাবে এক ধরনের ‘ডিমোগ্রাফিক ক্লিনজিং’ চলছে, যেখানে স্থায়ীভাবে গাজাবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
নেতানিয়াহুর গোপন বার্তা: “ফিরে আসার কিছুই থাকবে না”:
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক গোপন বৈঠকে সংসদ সদস্যদের বলেন:
“আমরা যত বেশি বাড়িঘর ধ্বংস করব, তত বেশি ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘ফিরে যাওয়ার’ কিছু থাকবে না।”
এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয়। ঘরবাড়ি ধ্বংস করে যদি একটি জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়, সেটি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের পরিপন্থী।
বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি: একজন গাজাবাসীর করুণ কাহিনি:
মোয়াতাজ ইউসুফ আহমেদ আল-আবসি, তেল আল-সুলতানের বাসিন্দা বলেন:
“যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে আমি নতুন বাড়িতে উঠেছিলাম। আমি ছিলাম আনন্দিত। ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন ছিল। এখন আমার সব ধ্বংস হয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন:
“সব হারিয়েছি। আমার কোনো ঘর নেই, কোনো আশ্রয় নেই। এখন শুধু ধ্বংসস্তূপ।”
এই ধরণের অভিজ্ঞতা হাজার হাজার গাজাবাসীর জন্য প্রতিদিনের বাস্তবতা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নীরবতা নাকি নিষ্ক্রিয়তা?
জাতিসংঘ এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের এই ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি শুধু মানবিক নয়, রাজনৈতিক ব্যর্থতাও বটে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন: আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিশ্লেষণ:
জেনেভা কনভেনশন অনুসারে, যুদ্ধকালীন সময়ে বেসামরিক ঘরবাড়ি ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। ফেসবুকের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ এবং প্রকাশ্যে এসব কাজ চালানোর ফলে তা যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে কিনা – তা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বৈত ভূমিকা:
একদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ধ্বংসযজ্ঞে জনবল নিয়োগ করা হচ্ছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার রিপোর্ট ও তদন্তেই বেরিয়ে আসছে এর বাস্তবতা। ফেসবুকসহ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়িত্ব রয়েছে এসব অপব্যবহার ঠেকানোর, কিন্তু সেই দায়িত্ব এখনো দৃশ্যমান নয়।
উপসংহার: একটি জাতির অস্তিত্বের উপর আঘাত:
গাজা উপত্যকায় ভবন ধ্বংসের জন্য প্রকাশ্যে ঠিকাদার ও মেশিন অপারেটর নিয়োগ নিঃসন্দেহে মানবিক ও রাজনৈতিকভাবে গভীর উদ্বেগের বিষয়। এই ধ্বংস শুধু ইট-পাথরের নয়, বরং মানুষের স্বপ্ন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধ্বংসও বটে।
এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। এখন সময় এসেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বিষয়টিকে আর এড়িয়ে না গিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিক।
📌 সম্পর্কিত সংবাদ:
📢 Finix News – সত্য বলার সাহস
🌐 www.finixnews.com