ঐকমত্য কমিশনকে ঘিরে মতানৈক্য: সংস্কার চাই সবাই, কিন্তু কোন পথে যাবে সংবিধান?
নিজস্ব প্রতিবেদক, ফিনিক্স নিউজ | finix news
তারিখ: ২৬ মে ২০২৫ | ঢাকা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ হয়েছে রাজনৈতিক দলের আপাত-সম্মতিতে, কিন্তু অন্তর্গত মতপার্থক্য এখনই প্রকট। সংবিধান সংস্কারে সব পক্ষ আগ্রহী হলেও, কেমন হবে সেই কাঠামো, এই প্রশ্নে দলগুলো একে অপরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছে।
কমিশনের প্রস্তাবনায় আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে সংসদের উচ্চকক্ষ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ এবং বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা। এসব বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক দল সরাসরি ‘না’ বলছে না, কিন্তু ‘হ্যাঁ’ বলার ভাষাটাও তাদের ভিন্ন।
উচ্চকক্ষ: এক কাঠামো, তিন ব্যাখ্যা
সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে একটি নীতিগত ঐকমত্যের আভাস মিলেছে। তবে বিএনপি উচ্চকক্ষে সংরক্ষিত নারী আসনের মতো নির্বাচনবহির্ভূত ব্যবস্থা চাইছে, যেখানে জামায়াতে ইসলামি বলছে, “জনগণ যাকে ভোট দিয়েছে, তারাই উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবে।” এনসিপি আবার বলছে, “তিন কোটি ভোট পেয়ে ২৯টি আসনে থেমে থাকা রাজনৈতিক শক্তির উচ্চকক্ষে সুযোগ চাই।” অর্থাৎ উচ্চকক্ষ কীভাবে জনমতের প্রতিফলন ঘটাবে—সেখানে মূলত সংঘর্ষ।
‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ নিয়ে দ্বৈত মানসিকতা
প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ, বিচারপতি নির্বাচন কিংবা সাংবিধানিক deadlock ভাঙতে এনসিসি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। বিএনপি এটিকে ‘আধা-অসামরিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো’ মনে করে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব হ্রাস পাবে। জামায়াত বলছে, “রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির মতো অনির্বাচিত ব্যক্তিদের কাউন্সিলে রাখলে ক্ষমতার ভারসাম্য আর থাকবে না।” এনসিপি এই কাঠামো মানতে প্রস্তুত, যদি তাতে ‘জনগণের অবিচ্ছেদ্য নিয়ন্ত্রণ’ নিশ্চিত করা যায়।
মেয়াদ নির্ধারণের প্রশ্নে ‘ব্যক্তি বনাম নীতি’র দ্বন্দ্ব
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাবে সব পক্ষ নীতিগতভাবে একমত হলেও, ব্যাখ্যায় বিভ্রান্তি স্পষ্ট। বিএনপি চায়, একজন ব্যক্তি টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারলেও বিরতির পর সুযোগ পাক। জামায়াত চাইছে ১০ বছরের বেশি না, আর এনসিপি বলছে—“দুই মেয়াদেই শেষ, রাষ্ট্র এক ব্যক্তির হাতে জিম্মি হতে পারে না।” এই ত্রিমাত্রিক অবস্থান ‘দলনির্ভর স্বার্থ বনাম প্রাতিষ্ঠানিক নীতির’ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
সংবিধান সংস্কার কেমন হবে: আইন, গণপরিষদ না গণভোট?
এখানেই এসে সবচেয়ে বড় মতপার্থক্য স্পষ্ট। বিএনপি চাইছে একটি দ্রুত সংসদীয় প্রক্রিয়ায় আইন করে সংস্কার; জামায়াত চাইছে গণভোট; এনসিপি বলছে, জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে নতুন গণপরিষদ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব সম্ভব নয়। এখানে স্পষ্ট হচ্ছে—কার কতটা আস্থা আছে জনগণের বিচারবোধে, আর কতটা আছে নিজস্ব কৌশলে।
বিশেষ ইস্যু: যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিচার বনাম রাজনীতি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অভিযোগ গৃহীত হলে অভিযুক্তদের নির্বাচন থেকে অযোগ্য ঘোষণা করার প্রস্তাব নিয়েও মতবিরোধ। জামায়াত দীর্ঘ দিন পরে এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও বিএনপি বলছে, “এটি একটি রাজনৈতিক ফাঁদ হতে পারে।” এনসিপি এখনো ‘পজিশন নেয়নি’, কিন্তু আলোচনায় স্পষ্ট যে, এই ইস্যু আবার সামনে আসতে যাচ্ছে।
ফিনিক্স বিশ্লেষণ:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে রাজনীতি হয়তো পেছনের দরজা দিয়ে কিছু আপস খুঁজবে। কিন্তু যে বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে—তা হলো, সব দল সংস্কারের কথা বলছে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বাংলাদেশ কল্পনা করছে।
প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে:
এই ভিন্ন কল্পনার ভেতরেই কি জন্ম নেবে নতুন এক রাষ্ট্রচিন্তা? নাকি এই মতানৈক্যই আবার ফিরিয়ে আনবে পুরনো অবিশ্বাস?
ফিনিক্স নিউজ ডেস্ক
www.finixnews.com
ইমেইল: info@finixnews.com