Tuesday, July 29, 2025
Homeউত্তরবঙ্গতিস্তা সেতুর ১১ বছরের প্রতীক্ষা: বারবার উদ্বোধন পিছিয়ে বাড়ছে জনঅসন্তোষ!

তিস্তা সেতুর ১১ বছরের প্রতীক্ষা: বারবার উদ্বোধন পিছিয়ে বাড়ছে জনঅসন্তোষ!

তিস্তা সেতু১১ বছরের প্রতীক্ষা: বারবার উদ্বোধন পিছিয়ে বাড়ছে জনঅসন্তোষ!

📍 Finix News Desk | কুড়িগ্রাম চিলমারী
🗓️ প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৫


উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আবারও বিলম্ব:

দীর্ঘ ১১ বছরের প্রতীক্ষা শেষে যখন গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা সেতুর উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এসেছিল, তখনই আবারও এসে দাঁড়িয়েছে অনিশ্চয়তার দেয়াল। ১,৪৯০ মিটার দীর্ঘ এই গার্ডার সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের তারিখ ২ আগস্ট থেকে পিছিয়ে ২৫ আগস্ট ২০২৫ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা এই প্রকল্পে চতুর্থবারের মতো সময় পেছানোর ঘটনা।

যেখানে একটি সেতু বদলে দিতে পারত গোটা উত্তরাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, সেখানে অব্যবস্থাপনা, ধীরগতি ও পরিকল্পনার অসামঞ্জস্য প্রকল্পটিকে করে তুলেছে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু।


তিস্তা সেতুর ১১ বছরের প্রতীক্ষা: বারবার উদ্বোধন অনিশ্চয়তা!
ছবি: সংগৃহীত | তিস্তা সেতুর ১১ বছরের প্রতীক্ষা: বারবার উদ্বোধন অনিশ্চয়তা!

একটি সেতু, অনেক সম্ভাবনা:

তিস্তা নদীর উপর গড়ে ওঠা এই সেতুটি শুধু গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের চিলমারীকে সংযুক্ত করবে না, এটি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে কুড়িগ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার কমিয়ে আনবে। এর ফলে সময়, খরচ ও শ্রমের সাশ্রয় হবে বিশালভাবে। পরিবহন খরচ কমবে প্রায় ৩০ শতাংশ, যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায়।

পরিবহন শ্রমিকরা জানান, আগে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় যেতে সময় লাগত ৮ ঘণ্টার বেশি, এখন তা নামবে ৬ ঘণ্টার নিচে।


প্রকল্পের বিবরণ ও কাঠামোগত তথ্য:

সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, যার অর্থায়ন করছে সৌদি ডেভেলপমেন্ট ফান্ড। পুরো প্রকল্পের আওতায় রয়েছে:

  • সেতুর দৈর্ঘ্য: ১,৪৯০ মিটার
  • স্প্যান সংখ্যা: ৩১টি
  • পাইল সংখ্যা: ২৯০টি
  • সংযোগ সড়ক: প্রায় ৮৬ কিলোমিটার
  • নদী শাসন: ৩.৫ কিমি
  • ভূমি অধিগ্রহণ: ১৩৩ একর

এছাড়া সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক—গাইবান্ধা ও চিলমারীর দিকে।


অপূর্ণ সংযোগ সড়ক: উদ্বোধনের পথে বড় বাধা:

যেখানে মূল সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম প্রায় শেষ, সেখানে সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে চিলমারী অংশের সংযোগ সড়ক নিয়ে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চিলমারী প্রান্তে প্রস্তাবিত ৩.৮ কিমি সংযোগ সড়কের মধ্যে এখনও প্রায় ২.৫ কিমি রাস্তার কার্পেটিং অসম্পূর্ণ

স্থানীয়রা জানান, “রাস্তা পাকা না হলে সেতু দিয়ে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। খালি কাঠামো থাকলে জনগণের কোনো উপকার হবে না।”

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রমিক ও যন্ত্রপাতির অভাব, বর্ষা মৌসুম ও পিচ সরবরাহ বিলম্বের কথা বলা হলেও বাস্তবে এসব অজুহাত জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনছে না।


প্রশাসনের বারবার আশ্বাস, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন:

সর্বশেষ ১৩ জুলাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শামীম বেপারীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ২ আগস্ট উদ্বোধনের দিন নির্ধারণ করা হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী তপন কুমার চক্রবর্তী জানালেন, উদ্বোধন পেছানো হয়েছে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত

কেন আবারও তারিখ পরিবর্তন? মন্ত্রণালয় থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আসেনি। তবে এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, সংযোগ সড়ক ও বিদ্যুতায়নের কাজ এখনও শেষ হয়নি।


স্থানীয় ক্ষোভ: উন্নয়ন না উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা?

হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোজাহারুল ইসলাম বলেন,

“এভাবে বারবার তারিখ পেছানোর অর্থ কী? সচিব থেকে উপসচিব – কারোর কথারই আর ভরসা থাকে না।”

একজন শিক্ষার্থী বলেন,

“আমরা ভেবেছিলাম সেতু দিয়ে স্কুলে যেতে পারব। কিন্তু এখনো কাঁচা রাস্তা দেখে হতাশ।”

কৃষক আব্দুল হালিম বলেন,

“আমরা ভেবেছিলাম সেতু আসলে ব্যবসা বাড়বে, সময় বাঁচবে। এখন মনে হচ্ছে সেতু আছে, রাস্তা নেই।”


অতীত ইতিহাস ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতা:

এই সেতুর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস। ২০০০ সালে শুরু হওয়া দাবির পর ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর একনেক থেকে অনুমোদন আসে ২০২০ সালের ৬ জুলাই।

প্রথমে উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ২০১৮, পরে ২০২১, এরপর ২০২৪ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের আগস্ট। এই ধারা জনগণের মনে এক ধরনের ‘ভুয়া প্রতিশ্রুতির সংস্কৃতি’র জন্ম দিয়েছে।


অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বনাম দেরির প্রভাব:

সেতুটি চালু হলে:

  • কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও রংপুর অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে,
  • মাছ, ধান, শাকসবজি ও অন্যান্য কৃষিপণ্য দ্রুত ঢাকার বাজারে পৌঁছানো যাবে,
  • চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুরসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে

কিন্তু বারবার বিলম্বের ফলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমছে, তরুণ উদ্যোক্তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসছেন।


বিশেষজ্ঞদের মতামত: উন্নয়ন মানে কেবল কাঠামো নয়, টেকসই বাস্তবায়ন:

এসএএস-এর নির্বাহী পরিচালক এ বি এম নূরুল আকতার মঞ্জুর বলেন,

“এই প্রকল্প বারবার সময় পেছাচ্ছে, এতে মানুষের আস্থা কমছে। উন্নয়ন মানে শুধু ফিতা কাটা নয়, মানসম্পন্ন টেকসই বাস্তবায়নই আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।”

স্থানীয় অর্থনীতিবিদ রওশন আরা তমালী জানান,

“তিস্তা সেতুর মাধ্যমে এক নতুন অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠতে পারে, কিন্তু পরিকল্পনার ঘাটতি সেই সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিচ্ছে।”


উন্নয়ন যেন হয় জনগণের, শুধু সরকারের নয়:

তিস্তা সেতু প্রকল্প নিঃসন্দেহে একটি বড় উন্নয়ন কর্মসূচি। কিন্তু এত বছরের পরিকল্পনা ও অর্থ ব্যয়ের পরও যদি জনগণ তার সুফল না পায়, তাহলে তা শুধুই কাগজে কলমে উন্নয়ন।
এখন প্রয়োজন কাজের গতি বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা এবং সর্বোপরি সময়মতো মানসম্পন্ন কাজের সমাপ্তি।

২ আগস্ট নয়, ২৫ আগস্ট কি সত্যিই হবে তিস্তা সেতুর আলোর দিন?
এই প্রশ্ন এখন শুধু কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা নয়, পুরো দেশের মানুষের।


আরও পড়ুন | Read More
আরও পড়ুন | Read More...

সর্বাধিক পঠিত | Popular Post