অর্থনৈতিক সংকট পেরিয়ে পাখির জিপিএ-৫: টিউশনি করে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখলো পাখি।
ডেস্ক রিপোর্ট | ফিনিক্স নিউজ | ১৩ জুলাই ২৫ইং
কোনো অভাব-অনটন কিংবা প্রতিকূলতা ইয়াসমিন আক্তার পাখিকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। আর্থিক সঙ্কট আর সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও নিজের দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেছেন তিনি। কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন এই অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থী।
দরিদ্রতার মাঝেও অদম্য আত্মবিশ্বাস:
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম রায়গঞ্জ গ্রামের আবুল কালামের মেয়ে ইয়াসমিন আক্তার পাখি ভুরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় আলহাজ মাহমুদ আলী বি এল বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। পাখির বাবা একজন ক্ষুদ্র মুদি দোকানি আর মা একজন গৃহিণী। এই সাধারণ পারিবারিক পটভূমিতে বেড়ে উঠলেও, পাখির স্বপ্ন ছিল অসাধারণ।
পাখির শিক্ষা জীবন শুরু থেকেই ছিল সংগ্রামী। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই সে পারিবারিক অর্থনৈতিক চাপে টিউশনি করা শুরু করে। তার উপার্জিত অর্থ দিয়েই নিজের লেখাপড়ার খরচ চালায় এবং সংসারেও কিছুটা সহায়তা করে। এই দুঃসময়ে সে নিজেকে কখনো দুর্বল মনে করেনি, বরং নিজের প্রতি আস্থা রেখেই এগিয়ে গেছে।
স্বপ্ন একজন চিকিৎসক হওয়ার:
পাখির লক্ষ্য একদিন একজন ডাক্তার হয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের সেবা করা। এই স্বপ্নই তাকে কঠিন সময়েও শক্তি জুগিয়েছে। তার কথায়, “আমি টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি। সংসারের টানাপোড়েনের মাঝেও আমি চেষ্টা করেছি নিজের পড়াশোনা ধরে রাখতে। আমি চাই একদিন ডাক্তার হয়ে এই গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করতে।”
তার মা-বাবাও মেয়ের এই সংগ্রাম দেখে গর্বিত। পাখির বাবা মো. আবুল কালাম বলেন, “মেয়ে আমার খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করছে। আমরা তেমন কিছু করতে পারিনি, কিন্তু ও ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রম করছে। সপ্তম শ্রেণি থেকে ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে নিজের খরচ চালিয়েছে। এখন ওর স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া—আমি চাই সেই স্বপ্নটা যেন পূরণ হয়।”
প্রতিবেশীদের গর্ব পাখি:
পাখির সাফল্যে খুশি পুরো গ্রামবাসী। স্থানীয় বাসিন্দা হাবিব মিয়া (৫০) বলেন, “পাখি খুবই পরিশ্রমী মেয়ে। আমি দেখেছি, সে শুধু নিজের পড়াশোনাই করে না, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকেও পড়ায়। অনেক কষ্ট করেও সে কখনো পড়াশোনা ছাড়েনি। জিপিএ-৫ পাওয়ায় আমরা খুবই গর্বিত।”
আরেক প্রতিবেশি মোছা. আনোয়ারা বেগম (৫৫) বলেন, “পাখি আমাদের গ্রামের গর্ব। এমন কঠিন সময়ে থেকেও সে হাল ছাড়েনি। ইনশাআল্লাহ ও একদিন বড় ডাক্তার হবে।”
শিক্ষকের চোখে পাখি:
আন্ধারীঝাড় আলহাজ মাহমুদ আলী বি এল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, “পাখি আমাদের বিদ্যালয়ের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। সে সব সময় খুব মনোযোগী ছিল এবং ভালো ফলাফল করেছে। এবারে আমাদের বিদ্যালয় থেকে ১৪৭ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়, এর মধ্যে ২৪ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। পাখির সাফল্যে আমরা গর্বিত।”
শিক্ষায় নারীর এগিয়ে চলা:
পাখির গল্প শুধুমাত্র একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর গল্প নয়, এটি একটি সামাজিক বাস্তবতা ও অনুপ্রেরণার প্রতিচ্ছবি। দারিদ্র্য, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে থেকেও নারীর এগিয়ে যাওয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইয়াসমিন আক্তার পাখি। তার এই অগ্রযাত্রা হয়তো আরও অনেক মেয়েকে সাহস দেবে কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য।
সরকারি সহায়তা প্রয়োজন:
এমন মেধাবী ও সংগ্রামী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। শুধু জিপিএ-৫ পাওয়া নয়, উচ্চশিক্ষায় সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে তার জন্য পর্যাপ্ত বৃত্তি, কোচিং সাপোর্ট ও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। পাখির মতো হাজারো শিক্ষার্থী আছে যারা প্রতিদিন সংগ্রাম করছে, কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণে সমাজ ও রাষ্ট্রের আরও বড় ভূমিকা রাখা উচিত।
ইয়াসমিন আক্তার পাখির গল্পটি প্রমাণ করে, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কখনো ইচ্ছাশক্তির সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কঠোর পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস এবং পরিবারের সমর্থন থাকলে যে কোনো প্রতিকূলতা জয় করা সম্ভব। পাখি যেমন করে দেখিয়েছে—অভাবের দেয়াল টপকে, আলোয় পৌঁছানো যায়। এখন প্রয়োজন তার মতো স্বপ্নবাজদের পাশে সমাজের সক্রিয় ভূমিকা।
📢 আপনিও যদি পাখির মতো কোনো সংগ্রামী শিক্ষার্থীর গল্প জানেন, আমাদের সঙ্গে শেয়ার করুন: [email protected]
📲 এমনই সত্য অনুপ্রেরণার গল্প পেতে চোখ রাখুন: www.finixnews.com