ভয়ংকর এনজিও ঋণের ফাঁদ: বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জীবনে এনজিও ঋণের অভিশাপ!
এনজিও ঋণ এখন ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে উঠছে। কিস্তির চাপে আত্মহত্যা, খুন কিংবা জেল, এসব ঘটনার পেছনে মানুষ নয়, দায়ী ভঙ্গুর অর্থনীতি ও কিছু এনজিওর উচ্চ সুদের ফাঁদ।
২০২৪ সালের ১৬ মে, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন আব্দুল মালেক নামে এক ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ী। তার এই করুণ মৃত্যুর পেছনে ছিল একাধিক এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের চাপ, এনজিও ঋণের ফাঁদ। একই বছর মার্চে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটে আরও দুটি মর্মান্তিক ঘটনা। কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় কুমিল্লায় শামছুন্নাহার নামে এক নারী আত্মহত্যা করেন, আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাত্র ১০ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধ করতে না পারা নিয়ে বন্ধুর হাতে খুন হন অটোরিকশাচালক আল আমিন।
এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং দেশের বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে প্রতিদিন ঘটে চলেছে এমন অসংখ্য ঘটনা।
ঋণ নেওয়া সহজ, ফেরত দেওয়া কঠিন:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্যমতে, দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবার তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য ঋণের ওপর নির্ভরশীল। শহরের তুলনায় গ্রামে এই হার বেশি। অনেকেই ঋণ নেন খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা বা বাসা ভাড়ার জন্য। এনজিওগুলো বছরে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ সুদের কথা বললেও সপ্তাহভিত্তিক কিস্তি আদায় এবং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের ফলে কার্যকর সুদের হার ২০-৩৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়।
কিস্তির চাপ ও আত্মহত্যা:
ঋণের চাপ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ কুড়িগ্রাম সদরের ইজিবাইক চালক মো. আয়নাল আলীর জীবনে দেখা যায়। তিনি দুটি এনজিও এবং একটি স্থানীয় সমিতি থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ইজিবাইক কিনেছেন। মাসিক আয় ১৫-২০ হাজার টাকা, কিন্তু সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে হয় ৪৫০০ টাকা। ফলে সংসার চালানো তো দূরের কথা, মাসের অনেক সময়েই কিস্তি দিতে না পেরে সুদের বোঝা বাড়ছে।
শুধু তাই নয়, এনজিও ও সমিতির চাপ, অপমান, বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে যাওয়া কিংবা কিস্তির টাকা না পেলে হুমকি, এনজিও ঋণের ফাঁদ, এসব যেন নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র হয়ে উঠেছে। আত্মহত্যা, খুনোখুনি, কারাবরণ, সবই এখন এই ঋণসর্বস্ব সমাজের পরিণতি।
আইনি জটিলতা ও মামলার ভয়:
বাংলাদেশে এনজিও বা সমিতি থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে, অনেক ক্ষেত্রেই ঋণগ্রহীতাকে জেলে যেতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের উলস্নাপাড়ায় উদ্দীপন নামে একটি এনজিওর ৩০ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে গৃহবধূ খালেদা আক্তারকে ২০২৪ সালে কারাবরণ করতে হয়, যদিও তিনি ইতোমধ্যে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছিলেন।
সারাদেশে সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৪৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যার মধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে ১২ হাজারের বেশি মানুষের নামে। এসব মামলায় গড়ে জনপ্রতি ঋণের পরিমাণ মাত্র ৩০ হাজার টাকা।
কেন এই অবস্থা?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসাভাড়া, সবকিছুর খরচ বেড়ে গেছে, কিন্তু মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পান না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা উচ্চ সুদের এনজিও ঋণের দিকে ঝুঁকছেন। আর সেই ঋণই পরিণত হচ্ছে ‘এনজিও ঋণের ফাঁদ’-এ।
সুদের নামে সর্বনাশ:
অনেক ক্ষেত্রেই এনজিওগুলো চুক্তি করার সময় ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তারা আইনি ব্যবস্থা নেয়। স্থানীয় সুদি মহাজনরা তো আরও একধাপ এগিয়ে, তারা বছরে ৩০-৩৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেন। এই ঋণের শর্ত এতটাই কঠিন যে কেউ ব্যর্থ হলে সর্বস্বান্ত হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।
সরকার ও সামাজিক করণীয়:
এনজিও ঋণের নামে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে নিচের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরি:
১. সুদের হার নির্ধারণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ:
- এনজিওগুলোর সুদের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করতে হবে (যেমন: ১২-১৫% এর বেশি নয়)।
- চক্রবৃদ্ধি সুদের হিসাব প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২. ঋণ আদায়ে অপমান-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ:
- জোর করে কিস্তি আদায়, বাড়িতে তালা মারা, মানহানিকর আচরণ, এসব বন্ধে প্রশাসনিক ও পুলিশি ব্যবস্থা নিতে হবে।
- এনজিও কর্মীদের আচরণবিধি নির্ধারণ ও তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. এনজিওগুলোর কার্যক্রমে কঠোর মনিটরিং ও লাইসেন্স ব্যবস্থা:
- MRA (Microcredit Regulatory Authority) এর ক্ষমতা বাড়িয়ে মাঠপর্যায়ে তদারকি জোরদার করা।
- যেসব এনজিও আর্থিক স্বচ্ছতা মানছে না, বার্ষিক অডিট জমা দিচ্ছে না, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা।
৪. স্বল্প সুদে সরকারি ঋণ ব্যবস্থা সহজ করা:
- ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষক, শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সহজ শর্তে সরকারি ঋণ স্কিম চালু করা।
- ব্যাংক ঋণের প্রক্রিয়া সহজ ও কাগজপত্র কমানো।
৫. এনজিও ঋণগ্রহীতাদের আইনি সহায়তা নিশ্চিত:
- ঋণগ্রহীতাদের জন্য সরকারি বা বেসরকারি লিগ্যাল এইড সেল গড়ে তোলা।
- কেউ জোর করে টাকা আদায় করলে বা হুমকি দিলে সহজে অভিযোগ জানানোর সিস্টেম (হেল্পলাইন/অ্যাপ) চালু করা।
৬. সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি:
- গ্রামীণ জনগণের মধ্যে ঋণ ব্যবস্থাপনা, সঞ্চয় এবং ব্যবসা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া।
- কিস্তির ফাঁদ, সুদের হিসাব বোঝাতে স্থানীয় স্কুল, মসজিদ-মন্দির বা ইউনিয়ন অফিসে সচেতনতামূলক সভা চালু।
এনজিও ঋণ এখন এক ভয়ংকর অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। আজকে যেসব মানুষ এনজিওর ঋণ নিয়ে আত্মহত্যা করছেন, খুন হচ্ছেন বা জেলে যাচ্ছেন, তারা কেউই দুষ্ট নয়, বরং একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামোর বলি। এনজিও ঋণের ফাঁদ -এর এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা দুটোই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এখনই সময়, ঋণের এই দানবকে নিয়ন্ত্রণে আনা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রকৃত অর্থে সহায়তা দেওয়ার।
আরো পড়ুন…
- বেনাপোলে ভারতীয় ‘লাগেজ পার্টি’: বিজনেস ভিসায় চোরাচালান, দেশীয় শিল্প হুমকিতে।
- কাশ্মীর সংঘাতে ২৫০’র বেশি ভারতীয় সেনা নিহত।
- দিনে স্কুলশিক্ষক, রাতে ভয়ংকর ডাকাত! গ্রেফতার ৪!
- ইলন মাস্কের নতুন দলকে ‘হাস্যকর’ বললেন ট্রাম্প।
Finix News | [email protected]
আরও তথ্য ও আপডেট: www.finixnews.com